সর্বশেষ আপডেট : ১১ ঘন্টা আগে
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

সরলতা, শৃঙ্খলা আর নীতির প্রতিচ্ছবি “শাহজাহান কমর”

মিজানুর রহমান ::

আপনি এত দ্রুত চলে যাবেন, এটা কখনো চিন্তায় ছিল না। জীবন এমনই—বেঁচে থাকাটাই যেন আশ্চর্যের, আর চলে যাওয়াটাই বাস্তব। আজ থেকে আপনি সারাজীবনের জন্য অবসরে চলে গেলেন—যে অবসরে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না।

লেখক, কবি, সাহিত্যিক—ছড়া, কবিতা, আবৃত্তি, ছোটগল্প, উপন্যাস—সবকিছুর সঙ্গে আপনার ছিলো নিবিড় সংযোগ। মানবহিতৈষী কাজ, পরোপকার ছিলো আপনার মূল সম্বল। জানি, যতই লিখি না কেন, আপনার সম্পর্কে সব বলা হবে না।
“আমার কাঁচা হাতের লেখা, আপনার মতো মানুষকে নিয়ে কতটুকুই বা প্রকাশ করতে পারবে?”—তবুও আমাকে লিখতেই হবে, বলতেই হবে। তাই আমি লিখছি…

আপনি যেন সম্রাট শাহজাহানের মতো ধরায় এসেছিলেন আর সম্রাটের মতোই চিরবিদায় নিলেন। আপনার তুলনা আপনি নিজেই। কী ছিল না আপনার—নাম, যশ, খ্যাতি! চাইলে এই ঢাকা শহরে বসেই আপনি শত শত কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন। বিত্ত-বৈভবে নিজেকে ভাসাতে পারতেন। একটু অনৈতিক পথে হাঁটলেই, যেটা আজকাল অনেকেই প্যাশনের মতো করে, আপনি সব পেতেন।

“দৈনিক আমাদের সময়” পত্রিকার মফস্বল বিভাগে থাকার সুবাদে গোটা দেশে আপনি এক শক্ত অবস্থানে ছিলেন। আটটি বিভাগীয় ব্যুরো চিফ ছিলো আপনার অধীনে। কত উপঢৌকন, কত শত খাম আসতো আপনার কাছে! দেশের নানা প্রান্ত থেকে কত মানুষ আপনাকে খুশি করতে চাইতো—শুধু আপনার নেকনজরে থাকার জন্য।

কিন্তু আপনি? সমস্ত কিছু বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নীতি-নৈতিকতায় ছিলেন সংগ্রামী, আপোষহীন, অটল, অবিচল। লোভ-লালসা আপনাকে টলাতে পারেনি। “জিরো টলারেন্স” ছিলো এসব বিষয়ে। সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন সবসময়—যাতে এসব অনৈতিক প্রভাব আপনার নিকটবর্তী হতে না পারে।

বাংলাদেশের কোনো জাতীয় দৈনিকে, জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু অবধি, আপনি টানা ২০ বছর মফস্বল সম্পাদকের পদে সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, নীতি-নৈতিকতা এবং আদর্শিকতা নিয়ে কাজ করেছেন। এটি বিরল ঘটনা—রীতিমতো রেকর্ড। যা একমাত্র আপনার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে।

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তই ছিলো আপনার সেই কমিটমেন্ট। আপনার মতো মহামানবরা এমনই হয়। একসময় সময় এসে যায়—বেলা ফুরায়। কাউকে না কাউকে জায়গা করে দিয়ে যেতে হয়। আপনিও সেটাই করে গেলেন।

আপনার প্রয়াণে ভাষা হারিয়ে গেছে। কী-বোর্ড চলছে না। মস্তিষ্কের কোষগুলো যেন খামচে ধরেছে। মাথার স্টেম সেল কার্যত কাজ করছে না। তবুও মন চাইছে—এই অধম আপনার বিষয়ে দু’কলম লিখুক! মানুষ জানুক, আপনাকে জানুক…

জৈন্তাবার্তা, আজকের সিলেট, বাংলাবাজার পত্রিকা পেরিয়ে ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পর্যন্ত আপনি এসে থামলেন। জীবনের তিন চতুর্থাংশ সময় পত্রিকা আর সংবাদ নিয়েই কাটিয়ে দিলেন।

কী নিভৃতচারী, কী প্রচারবিমুখ ছিলেন আপনি! যারা আপনার সংস্পর্শে এসেছেন, তারাই জানেন। কখনো চাইতেন না নিজের নাম হেডলাইনে আসুক। আড়ালে থেকে গড়ে গেছেন অসংখ্য সাংবাদিক। আপনি ছিলেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর। নিজের বেতনের টাকায় সহায়তা করেছেন মানুষকে, কিন্তু কখনো তা প্রচার করেননি। ঢাকা উত্তর শাহজাহানপুরের শহীদবাগের বাড়িতে যারা গেছে, তারা বুঝতে পেরেছে—কতটা অনাড়ম্বর জীবন লিড করেছেন আপনি।

সমাজের উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি আমলা, সচিব, অফিসার, এমপি-মন্ত্রী, মিডিয়ার বড় বড় সম্পাদক—সবার সঙ্গে ছিলো আপনার পরিচয়, জানাশোনা। তবে কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যাননি। আপনার সব কন্ট্রোলিং মেমোরিতেই ছিলো।

ভোররাতে যখন আপনার মৃত্যু সংবাদ শুনলাম, তখন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো—আপনি আর নেই! সেই যন্ত্রণা, যাতনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আপনার চিরবিদায়ের মিছিলে আমি শরিক হয়েছি—ভাঙ্গা মন, ভগ্ন হৃদয়ে, বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট নিয়ে।

আপনি নিঃসন্তান ছিলেন। কিন্তু সে কষ্ট কাউকে বুঝতে দেননি। আল্লাহর উপর আস্থা রেখে, সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। নিরহংকারী, সাদামাঠা জীবনযাপন ছিলো আপনার প্রিয়। মানুষকে সহজেই ইন্সপায়ার করতে পারতেন—নম্র ভাষণে, স্নিগ্ধ আচরণে। আপনার কোনো শত্রু ছিলো না—শুধু মিত্র আর শুভানুধ্যায়ী। বলুন তো, এমন জীবন কয়জনের হয়?

আমার স্পষ্ট মনে আছে—২০১২ সালে প্রবাস থেকে দেশে ফিরে, পেটের সমস্যার কারণে আপনার ঢাকাস্থ বাসায় ছিলাম ৬ দিন। খুব কাছ থেকে আপনাকে দেখেছি—সকালে অফিস, রাতে নামাজ, তাহাজ্জুদ, ফজর, আবার খবরের কাগজ, অফিস… কী ব্যস্ততা! সেই ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে ডাক্তার দেখানোর সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি। ফুফুকে দিয়ে সবসময় খোঁজ নিয়েছেন—আমি ঠিক আছি কি না। এই ভালোবাসা ভুলব কী করে?

বড়লেখায় আসার আগে ফোন করে বলতেন, “মিজান, আমরা ঢাকা থেকে আসছি, কাউন্টারে আসিস।” না বললে বাসায় পৌঁছে ফোন করে বলতেন, “মিজান, বাড়িতে আইছি, আসিস।” জন্মস্থান কালাউরাতে গিয়ে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের কবর জেয়ারত করতেন। বড়লেখায় ফিরে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। তারপর গাজিটেকায় গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার পিতা-মাতার কবর জেয়ারত করতেন। সব ভালো কাজ, সওয়াবের কাজে আপনাকে জড়িয়ে থাকতে হতো। সেটাই ছিলো আপনার পণ—“মানুষের জন্য, সমাজের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।”

আজ আপনি চলে গেছেন। সারাজীবন সংবাদ ছাপিয়েছেন, আজ সেই সংবাদপত্রেই আপনার মৃত্যুর খবর ছাপা হচ্ছে। প্রিয়তমা স্ত্রী, যাঁর সঙ্গে তিন দশকের দাম্পত্য জীবন, তাঁর সঙ্গেও কোনো বিদায়বেলা ছিলো না—চলে গেলেন সব স্মৃতি রেখে।

অফিসের সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী—সবাই আজ থমকে গেছে। নির্বাক হয়ে গেছে আপনার বিরহে। সব কিছুর যবনিকা টেনে, সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, সব কর্মব্যস্ততাকে একপাশে রেখে, আপনি চিরদিনের যাত্রায় পাড়ি জমালেন…

লেখক : প্রয়াত সাংবাদিক শাহজাহান কমর’র ভাতিজা (সমন্দিকের বড় ছেলে)

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

এ বিভাগের অন্যান্য খবর

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম
নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
মোবাইল: ০১৭১২ ৮৮৬ ৫০৩
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: