সর্বশেষ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

শিক্ষা উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অভিভাবকদের হা-হুতাশ

এমজেএইচ জামিল :

দফায় দফায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল মানুষ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে আছে। এরসাথে এখন যুক্ত হয়েছে শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। বাধাই করা খাতা, দিস্তা কাগজ, কলম, পেন্সিল, রং পেন্সিল, স্কেল, জ্যামিতি বক্স, সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর, বইসহ হেন কোন শিক্ষা উপকরণ নেই যেটির দাম বাড়েনি। এ নিয়ে অভিভাবকমহলে চলছে হা-হুতাশ।

নগরীর দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে জড়িত বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমপক্ষে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোনটি আবার দ্বিগুণও ছাড়িয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সন্তানদের পড়াশুনা চালিয়ে নিতে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো খাবার-দাবার কিংবা অন্যান্য খরচ থেকে কাটছাট করে কোন মতে সন্তানের পড়াশুনার খরচ যোগাচ্ছেন। আর নি¤œবিত্তদের কারো কারো সন্তানের পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রমই হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বই-খাতার পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি শিক্ষা-উপকরণের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। মানভেদে খাতার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা। কলমের দাম বেড়েছে ডজনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। মার্কিং করার ছোট কালার পেনের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। আগে যে প্রাকটিক্যাল খাতা ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ছিল, এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। স্টিলের স্কেল ১০ টাকা ও প্লাস্টিকের স্কেলের দাম বেড়েছে ৫ টাকা। জ্যামিতি বক্সের দামও বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা। বাজারে ফটোকপির চার্জও বেড়েছে। আগে এক পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে খরচ হতো দেড় থেকে দুই টাকা। এখন খরচ হয় দুই থেকে আড়াই টাকা। পাড়া-মহল্লায় ফটোকপির চার্জ অনেয়া হয় ৩ টাকারও বেশি। প্রতিটি প্লাস্টিক ফাইলের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। প্রতি ডজন পেনসিল ও রাবার ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে অভিভাবকদের।

নগরীর একটি স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফারদিন জানায়, আমাদের প্রতিমাসেই ম্যাথ করতে অন্তত ২টা খাতা লাগে। যে খাতাটা আগে ৩০ টাকায় পেতাম এখন তা কিনতে লাগে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বইপুস্তকের দাম তো বাড়ছেই। শুধু কলমের মূল্যটাই আগের মতো আছে। বাকি সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এদিকে বাবার সামান্য রোজগারে নিজেদের সংসারই চলে না। তার উপর আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নাঈমুর রহমান বলেন, মাস শেষে টিউশনি করে যে টাকাটা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকি। পরিবারের অবস্থাও নাজুক, তাদেরকে না পারতেছি কিছু দিতে আর না পারতেছি কিছু নিতে। তাই এমনিতেই বই-পুস্তক তেমন একটা কেনা হয় না। এদিকে শিক্ষা সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তা তো আরো বেশি সঙ্কুচিত হবে।

নাম প্রকাশ না করে নগরীর সুবিদবাজারের একজন অভিভাবক বলেন, আমার ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ওর অনেক খাতার দরকার হয়। আগে বিভিন্ন কোম্পানির বাইন্ডিং খাতা কিনে দিতাম। দাম বাড়ার কারণে খাতা কেনা কমিয়ে দিয়েছি। এখন দিস্তা খাতাই বেশি কিনে দিচ্ছি। শুধু খাতাই নয়, প্রতিটি শিক্ষা-উপকরণেরই দাম বেড়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছি।

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপকালে জানা গেছে, শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মানে অবশ্যই শিক্ষার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে এবারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আগের চেয়ে অনেক শিক্ষার্থীই কমে গেছে। করোনায় অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়েছে। করোনার সময় অনেক বাবা-মা চাকরি হারিয়েছে, অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছে, অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়লেও সরকার কোনোরকম প্রণোদনার ব্যবস্থা করেনি। এছাড়াও আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কথাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে মানুষের ব্যয়ও আগের তুলনায় বেড়ে যাবে। ফলে নি¤œ আয়ের পরিবার তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহনে অনেকটাই অক্ষম হয়ে পড়বে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই মাস আগেও নগরীর বিভিন্ন দোকানে এফোর ৮০ গ্রাম কাগজের দাম ছিল ২৮০টাকা, এখন সেটি ৪০০ থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লিগ্যাল কাগজের দাম ছিল ৪৮৫ টাকা, সেটি এখন ৫০০টাকা, রিম কাগজ ২৩-৩৬ সাইজের দাম ৩৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫০টাকা, ৫৫ গ্রাম কাগজ ২৩-৩৬ সাইজের দাম ৩৬০ টাকা থেকে এখন ৬০০টাকা। ৩০০ পেইজের খাতা ১১০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা, বসুন্ধরা ৩০০ পেইজের খাতা ১১৫ টাকা থেকে ১৮০ টাকা, ২০ টাকার খাতা ৩০ টাকা, ৪০ টাকার খাতা ৬০ টাকা, প্রতি ডজন কলমের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা করে বেড়েছে।

নগরীর সিলেট মডেল লাইব্রেরির প্রোপ্রাইটার মিজানুর রহমান জানান, দেশে বর্তমানে একটা মহাসঙ্কট চলছে। বিশেষ করে কাগজ সঙ্কটের কারণে সময়মতো পাঠ্যবই প্রকাশ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এরপরও শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। এই খাতটাকে সবকিছুর আগে গুরুত্ব দিতে হবে। ৬ মাসের ব্যবধানে ৩০০ টাকা রিমের কাগজের দাম যদি ৬০০ টাকা হয় তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় কি হতে যাচ্ছে তা কিছুটা অনুমেয়। নিত্যপণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে শিক্ষা উপকরণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা উপকরণ কেনা কমিয়ে দিয়েছে।

তিনি জানান, আমরা যারা লাইব্রেরী কিংবা শিক্ষা উপকরণ ব্যবসার সাথে আছি। তারা উভয় সঙ্কটে দিনাতিপাত করছি। একদিকে আমাদের নির্দিষ্ট আয় করা সম্ভব হচ্ছেনা, অপরদিকে আয় করতে গেলে অভিভাবকরা শিক্ষা উপকরণ কিনতে পারবেনা। তাই বাধ্য হয়ে আমরা মুনাফা কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এভাবে কতদিন সম্ভব হবে। আমাদের প্রত্যাশা অন্যান্য সেক্টর থেকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা সেক্টরকে দেখতে হবে। শিক্ষা উপকরণের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। অন্যথায় এর প্রভাব গোটা শিক্ষাক্ষেত্রে পড়লে দেশ জাতি ও রাষ্ট্রের অপুরনীয় ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।

নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় একটি স্টেশনারী দোকানে শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করতে আম্বরখানা গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রীর মা জানান, আমার স্বামী ছোট খাটো একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। আমার তিন মেয়ের বড় মেয়ে পড়ে ৭ম শ্রেণীতে, দ্বিতীয় মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আমার স্বামীর যা বেতন তাতে আমাদের সংসারই ঠিক মত চলে না। যদি খাতা কলমের দাম এভাবে বাড়ে তাহলে কীভাবে ক্রয় করবো। গত দুই মাস আগে যে খাতা কিনছি ২০টাকা করে সে টাকা বর্তমানে কিনতে হয় ৩০-৪০ টাকা দিয়ে। এভাবে খাতা কাগজের মূল্যবৃদ্ধি পেলে সন্তানদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হবে না।

জানা গেছে, শহরের থেকে আরো খারাপ পরিস্থিতি বিভিন্ন জেলা উপজেলায়। সেখানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মাধ্যম খাতা কলমের দাম বৃদ্ধিতে অভিভাবকদের এখন দিশেহারা অবস্থা। অভিভাবকরা মেটাতে পারছেনা শিক্ষার্থী ছেলে মেয়েদের চাহিদা। দুঃসহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার দিনমজুর রহিম উদ্দিন জানান, চলতি নভেম্বর মাসে খাতা কলম কিনতে গিয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন। ১২ টাকা দিস্তার কাগজ ২০ টাকা, ১৬ টাকারটা ৩০ টাকায় উঠেছে। তার ২ টা সন্তানের ১টা ৩য় শ্রেণীতে পড়ে আর আরেকটার বয়স ২ বছর। ১ সন্তানের পড়ালেখার ব্যয় মেটাতে গিয়ে তিনি দিশেহারা। রহিম উদ্দিন বলেন, শিক্ষা উপকরণের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে দোকানিরা তাকে বলেছেন, আমরা কি করবো, কাগজের দাম বাড়ছে ৬ মাস ধরে। চলতি নভেম্বরে বেড়েছে দুই দফা। এভাবে চললে ব্যবসা গুটানো ছাড়া উপায় থাকবেনা। যাদের দুই চারজন ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে তাদের যে কী অবস্থা ভাবতেও মাথা ঘুরে যায় !

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক মাস আগে এক দিস্তার বাঁধাই খাতা ছিল ৩৫ টাকা, এখন সেটি ৫০ টাকা। দেড় দিস্তার বাঁধাই খাতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। দুই দিস্তার বাঁধাই খাতা ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, এখন ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। তিন দিস্তার বাঁধাই খাতা ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, এখন ১১৫ টাকা। আর বসুন্ধরা, গুডলাকসহ বিভিন্ন কোম্পানির ৩০০ পাতার বাঁধাই খাতা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। এখন ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। সাধারণ মানের সাদা কাগজের দিস্তা ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। রাবার/ইরেজার ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। এখন ২৫ টাকা। সাধারণ পেনসিল ডজন ছিল ৮০ টাকা, এখন ১০০ টাকা। রং পেনসিল অয়েল পেস্টাল ১২ টি পেনসিলের একটি প্যাকেট ছিল ১০০ টাকা। এখন ১১০ টাকা। ৫৫ গ্রামের এক রিম কাগজের এক মাস আগে পাইকারি দাম ছিল ১ হাজার ৮৩০ থেকে ১৮৫০ টাকা, এখন ২ হাজার ৩০০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোচিং ও প্রাইভেট ফিও বেড়ে গেছে। অথচ আয় বাড়েনি। ফলে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষকে কেন্দ্র করে। কারণ নতুন বছর মানেই সন্তানকে ক্লাসে ভর্তি, নতুন বই, স্কুল পোশাকসহ আরও কত খরচ। সব মিলিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত সন্তানের শিক্ষা ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদের দাবি দেশে সঙ্কট আছে ঠিক। তবে সবার আগে শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ গেল ২ বছর করোনার কারণে শিক্ষার অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

এ বিভাগের অন্যান্য খবর

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: