সর্বশেষ আপডেট : ১৩ ঘন্টা আগে
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ-বেত পণ্য

মুনশী ইকবাল :

একটা সময় সিলেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের একটি ছিল বাঁশ-বেত শিল্প। কিন্তু একসময়ের অতি প্রয়োজনীয় এই শিল্প এখন হারিয়ে যাচ্ছে। কেবল টিকে আছে কিছু সৌখিন ক্রেতার জন্য। এ শিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, বাঁশ-বেতের পণ্য এখন আর প্রয়োজনীয় নয়, এটি এখন সৌখিন পণ্য।

শুরুতে প্রয়োজনের তাগিদে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বানাতেন গ্রামের গৃহস্থ নারীরা। যারা খুব ভালো বাঁশ-বেতের জিনিস বানাতে পারতেন তাদের কদর বাড়তে থাকে। ঘরের প্রয়োজনের বাইরে ধীরে ধীরে আশপাশের বাড়িঘরের জন্যও তারা এসব জিনিস বানাতে থাকেন। যা বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ে তারা বিক্রি করতেন। এসব বিনিময়ের মধ্যে ধান, চাল, মাছ ইত্যাদি ছিল প্রধান। বাঁশের তৈরি এসব জিনিসের মধ্যে সবার আগে ছিল হাতপাখা। এরবাইরে মুরগি রাখার ঝাঁপি, খোলই, ধান শুকানোর চাটাই ছিল প্রধান। মূলত ঘরের কাজের অবসরে দুপুরের পর তারা এসব বানানোর কাজ করতেন। আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এলে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের উপহার হিসেবেও এসব বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। নানান কারণে দিন দিন এসবের চাহিদা বাড়তে থাকে। একসময় তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়। তখন অনেক পরিবারের নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বানানে শুরু করেন। পরিবেশবান্ধব আর সহজলভ্য হওয়ায় তা গ্রামের সীমা ছড়িয়ে শহরেও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।

কাইতগ্রাম হরিপুর সিলেট থেকে ছবিদুটি ক্যামেরা বন্দি করেছেন রাফায়াত হক খান।

সিলেট নগরীর ক্বীনব্রিজের দুইপাড়ে গড়ে ওঠে বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রির অনেকগুলো দোকান। এর মাত্র ৩/৪টি এখন টিকে আছে। এগুলোও এখন ধুঁকছে। সময়ের স্রোতে এরাও হয়তো একসময় হারিয়ে যাবে। দোকনিরা জানান, বাঁশ পণ্যে এখন কারো আগ্রহ নেই। তাই বিক্রি একেবারে নেই বললেই চলে।

তাছাড়া বিভিন্ন গ্রামীণ বাজারে অনেকে দূর থেকে নারীদের বানানো বাঁশের জিনিসপত্র বিক্রি করতে নিয়ে আসতেন পুরুষরা। তখন থেকেই এই শিল্পটি অনেকের জন্যই জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। একে অবলম্বন করে বিভিন্ন বাড়িতে গড়ে ওঠে অনেকগুলো ছোটো ছোটা কারখানা। এরমধ্যে সিলেটে সবচেয়ে বেশি নাম ছিল বালাগঞ্জ উপজেলার। তাছাড়া পাশর্^বর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ, রাজনগর এবং জৈন্তাপুরের অনেক জায়গায়ও বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বাড়িতে বাঁশ-বেতের আসবাবপত্রের কারখানা গড়ে ওঠে। এসব এলাকায়ও আগের মতো নেই এ শিল্প।

বাড়ির আশপাশের বন জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা বাঁশ থেকেই তারা এসব তৈরি করতেন। অনেকেই বাড়িতে বাঁশের চাষ করতেন। তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে বনজঙ্গল। বাড়ির খালি জায়গা কমে গড়ে ওঠে ঘর। সময়ের পরিবর্তনে জিনিসের পত্রের দামের সাথে তাল মিলিয়ে বাঁশ-বেতের জিনিস বিক্রি করে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কমতে থাকে কাঁচামাল। বাঁশ-বেতের জায়গা এসে দখল করতে থাকে প্লাস্টিকের বিভিন্ন ছোটো ছোটো জিনিস। ফলে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। বাঁশ ও বেঁতের তৈরি পণ্যের কদর আর তেমন নেই বললেই চলে। ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এই শিল্পটি। এক সময় গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থলি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করলেও, এখন তা আর আগের মতো নেই।

বালাগঞ্জের সাংবাদিক ছড়াকার ইমন শাহ বলেন, একসময় বাঁশ বেতের জন্য বালাগঞ্জের নাম ছিল। তখন বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র। এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে চিরচেনা সেই চিত্র। অল্প কয়েকটি পরিবার জীবিকার তাগিদে বাঁশশিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

তিনি বলেন বর্তমানে স¦ল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়ায়, কুটির শিল্পের চাহিদা তেমন নেই। তাছাড়াও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এ শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ। এখন আর আগের মতো বাড়ির আশেপাশে বাঁশ ও বেত গাছ রাখছে না কেউ, সেগুলো কেটে মানুষ দালান তৈরি করছে, তাই কাঁচামাল আর আগের মতো সহজেই পাওয়া যায় না। বাজারগুলো দখল করেছে প্লাাস্টিক, এলুম্যানিয়াম, স্টিলসহ বিভিন্ন দ্রব্য। তাছাড়াও প্লাাস্টিক ও অন্যান্য দ্রব্যের পণ্য টেকসই ও স্বল্পমূল্যে পাওয়ায় সাধারণ মানুষের চোখ এখন সেগুলোর ওপর। এখন বাঁশ-বেতের পণ্যের ক্রেতা মূলত কিছু সৌখিন মানুষ।

এক সময় জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো গৃহস্থালী ও সৌখিন পণ্যসামগ্রী। বাড়ির পাশের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেক রকমের পণ্য। এখন কেবল গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতের তৈরি খোল, চাটাই, খোলুই, মোড়া, হাতপাখা কদাচিৎ চোখে পড়ে। বর্তমান সময়ে দ্রব্যমুলের দাম বেশি হওয়ায়, স্বল্প আয়ের এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কয়েক দশক আগে সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হতো বাঁশ বেতের তৈরি পণ্য। আগে যে বাঁশ ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেত সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ২শ থেকে আড়াইশ টাকায়। কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়েনি। নেই কোন সুযোগ সুবিধাও। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এই পেশার লোকজন। তাই অনেকেই এখন আর এই পেশায় আগ্রহী নন। বালাগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি পরিবার বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। কয়েকজন বিক্রেতা জানান, পূর্ব পুরুষের এ পেশা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মূলত বাপ দাদার আমল থেকে এই একটি পেশাই তারা জানেন তাই বিকল্প কিছু না থাকায় তাদের এটি করতে হচ্ছে। দিন দিন বিভিন্ন জিনিস-পত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। তাই এখন টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য নতুন প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় আগ্রহী নয়।

জৈন্তাপুর বাজারে কথা হয় আশি বছরের বৃদ্ধ ওয়ারিছ আলীর সাথে। তিনি কয়েকটি হাত পাখা নিয়ে এসেছিলেন। এগুলো তিনি অন্য জায়গা থেকে কিনে এনে বিক্রি করছেন। ওয়ারিছ আলী জানান, তার বাড়ি নিজপাঠ ইউনিয়নে। আগে তিনি বাড়িতে বাঁশের জিনিসপত্র বানাতেন। কিন্তু এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় আর কিছু বানাতে পারেন না। বাড়ির অন্য কেউও এতে আগ্রহী নয়। তাই বাইরে থেকে কিনে এনে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, একসময় যে পাখা ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেতো তা এখন ১শ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: