সর্বশেষ আপডেট : ৪ ঘন্টা আগে
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

ডিসি অফিসে কোটিপতি পিয়নরা

টিনের ছাউনির ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস। অন্যের বাড়ি বা অফিসে ঝাড়ু দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। হেঁটে কিংবা ভাঙা সাইকেল ঠেলে অফিস যাওয়া আসা। তিন বেলা অন্ন জোগানের খোঁজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম ছিল তাদের নিত্যদিনের চিত্র। অথচ মাত্র এক যুগের ব্যবধানে তারাই আজ শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। যাদের অর্থ, সম্পত্তি, বিত্ত নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে মুখরোচক নানা কাহিনী। যা ‘আলাদীনের চেরাগ’-এর গল্পকেও যেন হার মানায়। এরা আর কেউ নয়, মেহেরপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ৮-৯ জন পিয়ন। যারা ট্রেজারি শাখায় কাজ করে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মূলত সরকারি স্ট্যাম্প-কোর্ট ফি জালিয়াতি, বিক্রি ও পাচার, রাজস্ব তছরুপ এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে নিয়োগবাণিজ্য করে পিয়নদের এই চক্রটি অল্পদিনেই ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছে।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পিয়নদের ওই সিন্ডিকেটের প্রধান পিয়ন থেকে নাজির হওয়া (সম্প্রতি ১৪ কোটি টাকার স্ট্যাম্প পাচার অভিযোগে বরখাস্ত) রফিকুল ইসলাম। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনিসহ তার সিন্ডিকেটের সরকারি কর্মচারীদের শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনীর ব্যাপক প্রচার রয়েছে এলাকায়। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ক্ষমতাশালী জনপ্রতিনিধিদেরও ওই কর্মচারীদের দুর্নীতির টাকার ভাগ পাওয়ার কাহিনী প্রকাশ পায় কর্মকর্তা বদলি হলে কিংবা জনপ্রতিনিধি ক্ষমতা হারালে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্ট্যাম্প-কোর্ট ফি পাচার ও বিক্রি করে কোটিপতি হওয়া চক্রের প্রধান মেহেরপুর ডিসি অফিসের নাজির বা বড়বাবু (সম্প্রতি বরখাস্ত) রফিকুল ইসলাম ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন ট্রেজারির দায়িত্বে। এরমধ্যে এক বছর নাজির হিসেবে থাকলেও কোটি টাকা দিয়ে তদ্বির করে ফের ট্রেজারিতে তার যোগদানের আদেশ হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আর ওই তদ্বিরে ডিসির চাইতেও ছিল বড় হাতের নির্দেশ। ডিসি অফিসের পিয়ন থেকে নাজির হওয়া এই রফিকুল ইসলাম এখন শতকোটি টাকার মালিক। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যানুযায়ী তার জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৬২। শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। বাড়ি সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের খোকসা গ্রামে। এলাকায় বিএনপি নেতা বলে পরিচিত। দরিদ্র পিতা মীর মোকাদ্দেস আলীর সন্তান রফিকুল আমঝুপির রেশনিং ডিলার ফজলুল হকের বাড়িতে লজিং থাকতেন। সেখানে থেকে ৭/৮ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর ডিসি অফিসে এমএলএসএস (পিয়ন) পদে চাকরি হলে ওই বাড়ির মেয়ে মাহফুজা খাতুনকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক সূত্রে বিএনপি নেতার আত্মীয় হন। ডিসি অফিসে চাকরিকালে অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী তহমিনা খাতুনের সঙ্গে হয় সখ্য। এক পর্যায়ে তার কাছে হয়ে পড়েন ঋণগ্রস্ত। পরে ঋণমুক্ত হওয়ার শর্তে তহমিনাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হন রফিকুল। তারপর রাজনৈতিক প্রভাবে ডিসি অফিসের ট্রেজারি শাখার দায়িত্ব নিয়ে বসেন। এখন মেহেরপুরে শহরে এবং গ্রামে রফিকুল ও তার স্ত্রী-পুত্রের নামে শতবিঘার বেশি জমি আছে। এছাড়াও বিশাল মৎস্য খামার, গরুর খামার, অত্যাধুনিক ইটভাটা, সিডস ফার্ম, চানাচুর ফ্যাক্টরি, বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্সি, একাধিক পণ্যবাহী ভারী ট্রাক, মাইক্রোবাস এবং ঢাকার মিরপুর ও বাড্ডায় দুটি বাড়ি ছাড়াও মোট শতকোটি টাকার সম্পত্তি আছে তার। স্ট্যাম্প কেলেঙ্কারির ঘটনায় তিনি একাধিকবার আলোচনায় এসেছেন। তদন্ত হয়েছে। কিন্তু অর্থ আর প্রভাবে সব ধামাচাপা পড়ে যায়।

রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে রফিকুলের সম্পত্তির মালিক হওয়ার তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে মিলেছে ভয়ংকর তথ্য। দলিল নং-৪৪২১, বালাম-১৩০, পাতা ১০৫-১১১, রেজিস্ট্রি তারিখ-২৫/০৭/১৭, জমি-২০ কাঠা। জমির সাবেক মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, আমঝুপি চাঁদবিল মৌজায় প্রতিকাঠা জমির বর্তমান বাজার দর ৪-৫ লাখ টাকা। তিনি ওই জমিটি ৪৩ লাখ টাকায় রফিকুলের কাছে বিক্রি করেছেন। দলিল নং-৩৯০৩, বালাম-১৩৬, পাতা ১০৭-১১২, রেজিস্ট্রি তারিখ-২৫/০৫/১১, জমি-৭ শতক। শহরের সরকারি কলেজপাড়ায় এই জমিটির মূল্য রেজিস্ট্রি দলিলে ১ লাখ ২৫ টাকা দেখিয়েছেন রফিকুল। অথচ জমিটির দাতা ইমতিয়াজ হোসেন জানান, তিনি জমিটি ৩০ লাখ টাকায় রফিকুলের কাছে বিক্রি করেছেন। মেহেরপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহিনুর রহমান রিটন জানান, শহরে প্রতি শতক জমির মূল্য ১০-১২ লাখ টাকা। রাজস্ব ফাঁকির এমন দৃষ্টান্ত শতাধিক দলিলে আছে। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মূলত রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কম মূল্যে জমি ক্রয় দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা আড়াল করতে এই কৌশল বেছে নিয়েছেন রফিকুল। তার অবৈধ অর্থে অনেক নারী ও ব্যক্তির বহুতল বাড়ি ও গাড়িও হয়েছে। অথচ, ২০০৯ সালের আগে রফিকুলের কিছুই ছিল না।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলামের দাবি, তিনি কষ্ট করে স্ত্রী-পুত্রদের নামে সম্পত্তি গড়ে দিয়েছেন। মানুষ ছোট থেকে বড় হতেই পারে। সব সম্পত্তি বৈধভাবে কেনা।

আর রফিকুলের বড় ছেলে মোস্তাক আহমেদ মিলন দাবি করেন, সম্পত্তির বেশিরভাগ তাদের দুই ভাইয়ের অর্থে কেনা। তিনি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন ছিলেন। চার বছর আগে চাকরি ছেড়ে গ্রামে এসে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সম্পত্তি গড়েছেন।

তিনি বলেন, ‘১২ বছর মিডিয়াতে চাকরি করেছি। কোটি টাকার সম্পত্তি, ব্যবসা থাকতেই পারে।’ তবে তার ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান দোলন বলেন, ‘সম্পত্তি ও অর্থের বিষয়ে বড় ভাই আর বাপ সব জানে। আমি কিছুই জানি না।’

রফিকুলের দ্বিতীয় স্ত্রী ডিসি অফিসের সাবেক পরিছন্নতাকর্মী স্বশিক্ষিত তহমিনা খাতুনও এখন শতকোটি টাকার মালিক। তিনি শহরেই থাকেন। রফিকুল তার চতুর্থ স্বামী। মেহেরপুর শহরে তারও কোটি টাকার একাধিক প্লট, বাড়ি, দোকান, সম্পত্তি, ক্লিনিক, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ইটভাটা ছাড়াও পাঁচশ’ ইজিবাইক রয়েছে। মালবাহী ১০ চাকার ভারী ট্রাক আছে ডজনখানেক। মেহেরপুরে সিটি ব্যাংকের প্রধান এজেন্ট শাখাসহ দুটি শাখার অংশীদার তিনি। নিজ অর্থে হতদরিদ্র ৩ ভাই, ৬ বোনকে অর্থ-সম্পত্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তহমিনা। এমন নাটকীয় উত্থান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তহমিনা খাতুন অকপটে বলেন, ‘এক আইনজীবীর ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে ডিসি অফিসে চাকরি। তারপর জীবনে সব ধরনের পরিশ্রম করে অর্থবিত্ত গড়েছি। কিছু ব্যবসা ভাইয়েরা দেখাশোনা করে। কিছু ব্যবসা সৎ ছেলে মোস্তাক আহমেদ মিলন দেখে। তাই বলে কোনোকিছুই অবৈধ না, সব বৈধ।’

ডিসি অফিসের আরেক পিয়ন স্বশিক্ষিত সুফল হোসেন। পিতা-কালু মন্ডল। বাড়ি সদর উপজেলা চকশ্যামনগর গ্রামে। জন্ম ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। তিনি রফিকুলের সহযোগী হিসেবে ট্রেজারি শাখায় আছেন দীর্ঘদিন। রফিকুলের সংস্পর্শে থেকে তিনিও নিজের এবং ভাইয়ের নামে প্রায় ৪০ বিঘা সম্পত্তি কিনেছেন। মেহেরপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাড়ি ও দোকানসহ কোটি টাকা মূল্যের তিনটি জমি আছে তার। শহরে আলিশান বহুতল বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়াও একাধিক গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি শহরের ঘোষপাড়ায় মিজানুর রহমানের পাকাবাড়ি ও দোকানসহ চার কাঠা জমি কিনেছেন ৯৫ লাখ টাকায়। কিন্তু দলিলে দাম উল্লেখ আছে ৪০ লাখ টাকা। একই পাড়ায় রাজাবিড়ি ফ্যাক্টরির ১০ কাঠা জমি কিনেছেন এক কোটি টাকায়। অথচ জমিটির দলিল মূল্য দেখানো আছে ৩০ লাখ টাকা। তারও ছায়া পেয়ে অনেক নারী ও ব্যক্তি অর্থশালী হয়েছেন। পিয়নের চাকরি করে কীভাবে এত সম্পত্তি হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে সুফল হোসেন বলেন, ‘স্যারদের আদেশ শুনি। স্যাররা বদলির সময় খুশি হয়ে অনেক টাকা দিয়ে যায়। তাছাড়া সম্পত্তির প্রায় সবই বড় ভাই নজরুল ইসলামের নামে।’ এসব কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তার বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সম্পত্তি সবই সুফলের। আমি রক্ষকমাত্র। সকলেই রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কমমূল্যে সম্পত্তি নিয়ে কোটি কোটি টাকা আড়াল করেছেন।’

উল্লিখিত তিনজনের বাইরেও শহরের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত নূর ইসলামসহ ডিসি অফিসের আরও ৭-৮ জন ধনাঢ্য কর্মচারী রয়েছেন। যারা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোটিপতি হয়েছেন। এদের সবার কোটিপতি হওয়ার মুখরোচক দীর্ঘ কাহিনী আছে। যা গল্পের ‘আলাদীনের চেরাগ’কে হার মানাবে। অনুসন্ধানকালে স্থানীয় সকলেই জানান, এক যুগ আগে এদের সবাই অর্থ সম্পদহীন ছিল। সকলেই ডিসি অফিসে জাল স্ট্যাম্প, স্ট্যাম্প পাচার, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্য করে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন। তাদের সবাই দামি সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে দলিল করে কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। সবাইই অর্থ আড়াল করতে টাকা ব্যাংকে না রেখে শতকোটি টাকার জমি কিনে রেখেছেন।

তাদের উত্থান কাহিনীর বর্ণনা দিতে গিয়ে মেহেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বারিকুল ইসলাম লিজন বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা ছোটখাটো দুর্নীতি করলে গণমাধ্যমে ফলাও হয়। অথচ এদের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিক, প্রশাসন সব চুপ। এরা পিয়ন হলেও অনেক বড় হাত এদের আগলে রাখে। তাই যখনই ধরা পড়ে তখনই টাকা ছিটিয়ে ঘটনা ধাপাচাপা দেয়। এবারও ১৪ কোটি টাকার স্ট্যাম্প পাচার ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে।’

মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সৎ ডিসি’রা অবসরে গেলে কোনো কোটিপতির ফার্মে উচ্চ বেতনে চাকরি নেন। অথচ মেহেরপুর ডিসি অফিসে এমন কোটিপতি ৭-৮ পিয়ন রয়েছেন। এদের উত্থান কাহিনী সবাই জানে। কিন্তু প্রশাসন, ক্ষমতাবানদের সমর্থনের কারণে ওদের কিছুই হয় না। এসবের সঙ্গে যুক্ত সবার বিরুদ্ধে উচ্চতর তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মুনসুর আলম খান বলেন, ‘এ লজ্জা প্রশাসন ও মেহেরপুরের সবার। সবাই সঠিক ভূমিকা রাখলে এই অবস্থা হতো না। এই সমস্ত কালপ্রিটের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখানে মাত্র ৮-৯ মাস আগে এসেছি। নির্দেশ পেলে সব খতিয়ে দেখব।’ সূত্র: দেশরূপান্তর

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: