সর্বশেষ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

সোনার হরফে লেখা নাম স্যার ফজলে হাসান আবেদ


মোঃ কায়ছার আলী :: কথায় বলে, “শক্তিমানরা টিকে থাকেন আর দুর্বলরা হটে যান।” এই শক্তির অর্থ ডাইনোসরের শক্তি না। এ হচ্ছে মানুষের টিকে থাকার শক্তি। সেরা ও সাহসী কাজ করার শক্তি। এ শক্তিতে যাঁরা বলিয়ান এ বিজয়গাঁথা কেবল তাঁদের নিয়ে। বাসযোগ্য এ পৃথিবীতে উর্বর ভূমি অগণিত শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিয়েছেন। যাঁদের রয়েছে অনন্য অসাধারণ অবদান-কৃতিত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব আকাশচুম্বী। মেধা আর কর্মের কারণে দেশে বিদেশে সর্বত্রই তাঁরা প্রসংসিত এবং সম্মানিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতদিন থাকবে ততদিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কলম জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ এর নাম থাকবে। আবিষ্কারের জন্য টমাস আলভা এডিসন, মাইকেল ফ্যারাডে চার্লস ব্যাবেজ এবং মার্ক জুকারবার্গ এর নাম কখনও হারিয়ে যাবে না। মহান স্বাধীনতা এনে দেওয়ার জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম চিরভাস্বর থাকবে। এভাবে অনেকের নাম ইতিহাসে চিরকাল অমর এবং অম্লান রবে। আজকের লেখার মূল শিরোনাম হল স্যার ফজলে হাসান আবেদ কেসিএমজি ইমেরিটাস চেয়ার। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বাঙালীর গর্ব, অহংকার। পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার বাতিঘর, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতার গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরনীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে জীবদ্দশাতেই তিনি আলোকিত মানুষ এবং কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ১৯৩৬ সালের ২৭শে এপ্রিল তদানিন্তন সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচং উপজেলার কামালখানিপাড়া গ্রামে তিনি জমিদার পরিবারে বাবা সিদ্দিক হাসান এবং মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী, কুমিল্লা জিলা স্কুলে ৭ম থেকে ৮ম শ্রেণী, পাবনা জিলা স্কুলে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। সে বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার ভর্তি হন কিন্তু এই কোর্স অসমাপ্ত রেখে ঐ বছরেই লন্ডনে চলে যান এবং চার বছরের সি.এ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে কিছুদিন চাকুরি করার পর কানাডায় চলে যান সেখানেও চাকুরি করার পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এসে শেল ওয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের প্রলংকরী ঘূণিঝড় বিপন্ন দ্বীপ মনপুরায় ত্রান সেবা পরিচালনা করেন। সেটাই তাঁর জীবনের মানুষের জন্য কাজ করার প্রথম উদ্যোগ। বলা যেতে পারে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক বীজবোপণ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পাল্টে যায় তাঁর জীবনের গতিপথ, ১৯৭১ সালের যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য গড়ে তোলেন “অ্যাকশন বাংলাদেশ” এবং “হেল্প বাংলাদেশ” নামে দুটি সংগঠন। তখন প্রবাসের রাজপথে মিছিলে স্লোগান হত “জয়বাংলা” “জয় বঙ্গবন্ধু”, “গণহত্যা বন্ধ কর”, “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও।” প্রবাসে সংগঠন দুটোর নাম এবং তাঁর কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তিনি ছিলেন কত বড় প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারী তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে দরিদ্র, অসহায়, সর্বহারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee বা সংক্ষেপে BRAC প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্যার বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে অসহায় দুর্গত মানষের কাছে গিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করব। দেশ স্বাধীন হলে ভারত থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ফিরে এল। অসহায় ছিন্নমুল সেই মানুষদের জরুরী সেবা এবং ত্রাণ এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। যুদ্ধ চলাকালীন লন্ডনের সেই ফ্লাটটি বিক্রি করার টাকা নিজের কাছে রেখেছিলেন পরবর্তীতে সেই টাকা দিয়ে উত্তর পূর্ব সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত থানা শাল্লার পুরো এলাকা পরে দিরাই ও বানিয়াচংয়ের থানার কয়েকটি ইউনিয়নের ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেন। ব্র্যাকের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন। বর্তমানে দারিদ্র বিমোচনের পাশাপাশি জরুরী ত্রাণ সহায়তা, নারী পুরুষের লিঙ্গ সমতা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নগর উন্নয়ন, মানবাধিকার, ব্যাংক বীমা, মোবাইল ব্যাংকিং, আড়ং, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক নার্সারী, ফিশারিজ, প্রিন্টিং, সিল্ক, লবণ, স্যানিটারী এন্ড ডেলিভারী কিট, সিড, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার, হত দরিদ্রদের মেধাবৃত্তি, হাসপাতাল, অসংখ্য টপিক নিয়ে আপাময় জনতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষাকার্যক্রম, প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা, স্কুলে ব্র্যাক লাইব্রেরি, গ্রামের পিছিয়ে পড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেইস প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের জন্য মানসম্মত প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক তথ্য, তত্ত্ব ও প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের জন্য মেন্টর সহ বিভিন্ন মেধা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। আজ ব্র্যাক শুধু দেশেই নয় ১ লক্ষ কর্মী নিয়ে পৃথিবীর ১১টি দেশে ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন প্রকার সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। দরিদ্রদের আলোর দিশারী বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার তাঁর ব্র্যাকের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অগ্রগতি টিকাদান, মা ও শিশুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, যক্ষা প্রতিরোধসহ তাদের অনেক কর্মসূচী রয়েছে। আশির দশকে এদেশে ডায়রিয়া মহামারী রূপধারণ করলে রোগীদের বাঁচানোর জন্য ব্র্যাক বা তাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা বাড়ী বাড়ী গিয়ে খাবার স্যালাইন (একমুট গুড়, এক চিমটি লবন, আধাসের পানি) তৈরি করা শিখিয়ে দেন। তখন বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতার স্যালাইন বানানোর পদ্ধতি প্রচার করত। বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েটি দেশের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে শিক্ষাস্বাস্থ্য মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়নে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য ২০১০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে তাঁকে নাইট উপাধি (নামের আগে স্যার) দেওয়া হয়। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮০), ব্র্যাকের ইউনেস্কোর নোমা পুরস্কার (১৯৮৫), ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৭), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (২০১৫), শিক্ষায় অবদানের জন্য ইদান পুরস্কার ও স্বর্ণ পদক (২০১৯)। পৃথিবীর সর্বত্র এত যশ সম্মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, পুরস্কার পেয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং নির্মোহ। যেখানে তিনি যেতেন সেখানে সবার কথা শুনতেন এবং সাক্ষাতের জন্য সময় বের করে নিতেন। বক্তৃতা বা নীতিবাক্য দিয়ে নয় কাজের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন। জনহিতকর প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’ চালু করার পর সেটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০০২ সারের সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্ত্রীসহ এবং ২০০৫ সালে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন কর্ণধার বিল গেটস স্ত্রীসহ ব্র্যাকের কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করেন। ২০১০ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব স্যারকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের একজন হিসেবে নিয়োগ করেন। স্যার চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি ব্র্যাক থেকে বেতন নিই কিন্তু আমার নিজের কিছুই নেই। আমার নিজের বাড়ী নেই। ভাড়া করা ফ্লাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি তখনই নিজের জন্য কিছুই করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবস্থা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না।” তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব এবং নতুন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ২০১৯ সালের আগষ্ট মাসে তিনি স্বেচ্ছায় চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আবারও জীবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ২০১৯ সালের ২০শে ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে ঢাকায় অ্যাপোলো হাসপাতালে (বিদেশে গিয়ে নয়) রাত ৮টা ২৮ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তিনি ব্র্যাকসহ অসংখ্য জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের মাঝে চিরকাল বেঁচে রইবেন, যেখানে তাঁর সোনালী স্পর্শ আছে।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট,
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, kaisardinajpur@yahoo.com

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম
নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
মোবাইল: ০১৭১২ ৮৮৬ ৫০৩
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: