সর্বশেষ আপডেট : ৫ ঘন্টা আগে
শনিবার, ৪ মে ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

সীমান্তে গোলাগুলি, আতঙ্কে মানুষ

ডেইলি সিলেট ডেস্ক ::

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত ব্যাপক আকার নিয়েছে। গতকাল রবিবার থেকে রাখাইন রাজ্যভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) তাড়া খেয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৯৫ জন সদস্য আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের ওপার থেকে গতকাল বেশ কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রুতে। এতে অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে ঘর ছেড়েছে সীমান্ত লাগোয়া তিন গ্রামের মানুষ। আর সীমান্তের পাঁচটি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বিজিবি সদস্যরা রয়েছেন সতর্ক অবস্থানে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাখাইনে পাঁচটি সেনা ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর জান্তার কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। জান্তার অনুগত বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে রাখাইনে প্রচারপত্র সাঁটিয়ে দিয়েছে তারা।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইনে গতকাল দিনভর ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ এপার থেকেও শোনা যায়। ভেসে আসে বোমাবর্ষণের শব্দ। ওপার থেকে ছুটে আসা গুলিতে আহত হন এপারের বাংলাদেশি বাসিন্দারা। মর্টার শেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের বাংলাদেশ অংশের জনপদগুলোর বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা তমব্রু সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। থেমে থেমে গুলি ও বোমাবর্ষণ চলছে সীমান্তে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি মর্টার শেল এসে পড়েছে বাংলাদেশ ভূখন্ডে। ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, কোনারপাড়া, ভাজাবনিয়া, বাইশফাঁড়ি এলাকা থেকে শত শত পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মী জানান, বিজিপির তমব্রু রাইট ক্যাম্প এবং ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি ছাড়া প্রায় ৪৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় বিজিপির সব চৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে। তমব্রু রাইট ক্যাম্প এবং ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলের জন্য আরাকান আর্মি চেষ্টা চালাচ্ছে। জান্তার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে আরাকান আর্মির ওপর গোলাবর্ষণ করছে। গোলাগুলি আর গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে এপারের সীমান্তবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, সীমান্তের ওপার থেকে গতকালও বেশ কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ে তমব্রুর কোনারপাড়া, মাঝেরপাড়া ও বাজারপাড়া এলাকায়। এতে গুলিবিদ্ধ হন তিনজন। তারা হলেন কোনারপাড়ার বাসিন্দা প্রবীন্দ্র ধর (৫০), রহিমা বেগম (৪০) এবং আমির হোসেনের ছেলে শামশুল আলম। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আতঙ্কে ঘর ছেড়েছে এই তিন গ্রামের মানুষ।

ঘুমধুম ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আনোয়ার বলেন, গত শনিবার রাত ৩টার দিকে প্রচুর গুলির আওয়াজ শোনা গেছে। বাইশফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা নুরুল কবীরের বাড়িতে একটি গোলা এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া জানান, গত শনিবার বিকেলে গোলাগুলি শুরু হয় এবং শেষ হয় গতকাল ভোররাতে।

পাঁচ স্কুল বন্ধ: ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্তের কাছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তমব্রু পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বাইশারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘সীমান্তে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাঁচটি স্কুল এরই মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের লোকজনকে সতর্ক ও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য বলা হয়েছে।’

বিজিবি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে তমব্রু সীমান্তসংলগ্ন বিজিপির চৌকি ঘিরে অবস্থান নিতে শুরু করে আরাকান আর্মির সদস্যরা। পরদিন শনিবার রাত থেকে ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে আরাকান আর্মি। গতকাল ভোরে আরাকান আর্মি হামলার মাত্রা বাড়ালে কয়েক দফায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শূন্যরেখা পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন বিজিপি সদস্যরা। অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা রেখে তাদের তমব্রুর একটি স্কুলে আশ্রয় দেয় বিজিবি। গতকাল দুুপুরে বিজিপি হেলিকপ্টার থেকে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এর পাল্টা জবাব দিচ্ছে আরাকান আর্মির সদস্যরাও।

তমব্রু এলাকার বাসিন্দা রূপলা ধর বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। অনেক ভয় হচ্ছে, কখন কোন সময় কী হয়, তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদের পাশের এলাকার এক ঘরের চালের ওপর বিস্ফোরিত রকেট লঞ্চার এসে পড়েছে শুনেছি। অনেকের উঠানে গুলিও এসে পড়ছে। এ ঘটনায় ঘরের বাইরে যেতেও ভয় হচ্ছে।’

তমব্রু কোনারপাড়ার বাসিন্দা ভুলু বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে মর্টার শেলের বিস্ফোরিত অংশ আমার ঘরের চাল ভেদ করে ভেতরে পড়েছে। একটুর জন্য আমাদের পরিবার প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। আমরা খুব ভয়ে আছি, ঘরেও নিরাপদে থাকতে পারছি না।’

৩৪ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অনেক সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাদের সংখ্যা আপাতত বলা সম্ভব নয়। তারা দফায় দফায় আসছেন। সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবি বদ্ধপরিকর। সংঘর্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চললেও আমরা আমাদের দেশের ও সীমান্তবর্তী লোকজনের নিরাপত্তার স্বার্থে টহল জোরদার করেছি।’

বিদ্রোহীদের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের ঢুকে পড়ার ঘটনা এটিই প্রথম। বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে নেপিদোকেন্দ্রিক সামরিক শাসকের হাতে দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ অংশের নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক জায়গায় বিদ্রোহীরা আলাদা বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে।

রাখাইন রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময় এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য কাজ করছে। এ অবস্থায় রাখাইনে ধারাবাহিক সংঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় জান্তার অনুগত সেনা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে আরাকান আর্মি। এরকম একটি বার্তা দেখা গেছে রাখাইনের কিয়াকফিউ টাউনশিপে। এসব বার্তায় লেখা, ‘কা-জ্ঞান (কমনসেন্স) ব্যবহার করে আত্মসমর্পণ করুন এবং মানুষের আলিঙ্গনে আশ্রয়লাভ করুন।’

স্থানীয়রা জানায়, কিয়াকফিউ-ইয়াঙ্গুন হাইওয়েতের পাশে একটি গ্রামে এ ধরনের বার্তা পাওয়া গেছে। অন্যান্য এলাকায়ও তা দেখা গেছে। গত শনিবার সকালেই তা লাগানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জান্তার বাহিনীকে যুদ্ধ অথবা আত্মসমর্পণের একটি বেছে নিতে বলা হচ্ছে।

বার্তায় বলা হয়, ‘আশপাশের আরাকান আর্মির সদস্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন এবং জনগণের বিপ্লবের অংশ হোন। মানুষ আপনাদের ক্ষমা করতে প্রস্তুত। জান্তার অনুগত বাহিনীর সেনাদের উচিত হবে না, মিন অং হ্লাইয়ের (সামরিক জান্তাপ্রধান) লাভের জন্য মূল্যবান সময় নষ্ট করা। তাদের বরং মানুষের কাতারে আসা উচিত।’

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রাখাইনের পালেতওয়া অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ ছাড়া কিয়াকতাউ, ম্রাউক-ইউ, মিনবিয়া টাউনশিপে ব্যাপক লড়াই চলছে। কিয়াকফিউ জেলার রামরি টাউনশিপে জান্তার ঘাঁটির পতন হয়েছে এবং সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। ওই অঞ্চলগুলোর অনেক ঘাঁটি থেকে জান্তার সেনারা সরে পড়েছে। কিছু ঘাঁটিতে এখনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি জান্তা।

আরাকান আর্মি দাবি করেছে, তারা এখন পর্যন্ত জান্তার পাঁচটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর দখল করেছে। এগুলো হচ্ছে ৫৩৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৭তম আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৪কম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৫৪০তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এবং ৩৮০তম ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন। এ ছাড়া ৩৭৫তম ও ৩৭৬তম ব্যাটালিয়নের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথে রয়েছে আরাকান আর্মি। কিয়াকতাউয়ের এমওসি-৯ ঘাঁটিটিও হারানোর পথে জান্তা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: