সর্বশেষ আপডেট : ১২ ঘন্টা আগে
বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশের ঋণ, কার কাছে কত দেনা?

বড় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ যে ঋণ নিচ্ছে তার পরিমাণ মাত্র সাত বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন যে ঋণ করছে, তার একটি বড় অংশও যাচ্ছে সেই ঋণ পরিশোধের পেছনেই।

বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ শত বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করার পর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা বারবার বাংলাদেশকে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করছেন।

আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচে বেশি ঋণ নিয়েছে এবং নিচ্ছে।

পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বাণিজ্য, ডলার সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে।

বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঋণ পরিশোধ এবং ভবিষ্যতের ভাবনা থেকেই একটা দুশ্চিন্তা।

“একশ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণটা এর মধ্যে বেশিরভাগই সরকারের ঋণ। উনআশি বিলিয়ন ডলারতো সরকারের। সেটা জিডিপির সাথে তুলনা করলে সতের শতাংশের কাছাকাছি। খুব একটা চাপ না। কিন্তু পরিশোধ করার পরিমাণটা সুদ এবং আসল মিলিয়ে অনেক বেশি।”

সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বৈদেশিক ঋণ

বাংলাদেশ কার কাছে কতটা ঋণ রয়েছে সেই বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়। এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার।

এইই ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫৭ ভাগ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে ঋণ করেছে তার মধ্যে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত এই চারটি দেশই প্রধান।

দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেলায় বাংলাদেশ জাপানের কাছেই সবচে বেশি দেনায়। জাপানের কাছে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার। এরপরই রাশিয়ার কাছে ৫.০৯ বিলিয়ন, চীনের কাছে ৪.৭৬ বিলিয়ন এবং ভারতের কাছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋণী বাংলাদেশ।

বর্তমানে এ ঋণ আরো অনেক বেশি। কারণ ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫শ ৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে।

এর মধ্যে সবচে বেশি এডিবি থেকে ১৪০ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৯৬ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ।

একই সময়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় জাপান থেকে ১৩৫ কোটি, রাশিয়া থেকে ৮০ কোটি, চীন থেকে ৩৬ কোটি, ভারত থেকে ১৯ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে।

ফাহমিদা খাতুন বলছেন, “আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বলি, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে বলি আমাদের আরো রাস্তাঘাট সবইতো আমাদের বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। সেটা রাশিয়া, চীন, জাপান তাদের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে।

সেইগুলো কিছু চলমান আছে। এগুলোতো ফেরত দেয়ার পরিমাণটা আস্তে আস্তে বাড়বে। একদিকে পরিমাণটা বাড়বে আরেকদিকে চিন্তার বিষয় যে আমারতো টাকা নাই হাতে। এই কারণেই দুশ্চিন্তাটার বিষয় রয়েছে।”

ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির প্রবণতায় দেখা যায় সরকারের বৈদেশিক ঋণ এবং এর পরিশোধ দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের যে ঋণ ৫০ বিলিয়ন ছিল সেটি ২২-২৩ অর্থবছরে ৬২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এই ঋণ পরিশোধের ধারাও ঊর্ধ্বমুখী। পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। চলমান অর্থবছরের জন্য তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে বাজেটে। আগামী বছরগুলোতে সেটি চার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “একশ বিলিয়ন ডলার ক্রস করে ফেরেছি এখন। এটা কিন্তু অর্ধেকেরও কম ছিল এক দশক আগে। হঠাৎ করেই আমরা ডাবল করে ফেললাম কিন্তু। এই জায়গাটাতেই আমাদের ভাবতে হবে একটু যে আবার আমরা আবার ডাবল করে ফেললেতো মুশকিল হয়ে যাবে। হয়তো পাঁচ সাত বছরেই ডাবল হয়ে যেতে পারে যদি আমরা ঠিকমতো আমাদের ম্যানেজমেন্ট ঠিক না রাখি।”

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না উল্টো বিদেশে অর্থ পাচার, উচ্চ শিক্ষা ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন ডলারের বাড়তি ব্যায় হচ্ছে যেটা দুশ্চিন্তার বিষয়।

বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়

বাংলাদেশে বাস্তবতা হলো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে একটা বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা রয়েছে সরকারের কাঁধে। ডলারের রিজার্ভও ক্রমাগত কমছে। সেই সাথে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যয় আরো বেড়েছে টাকার অঙ্কে।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলছেন, বাংলাদেশকে আয় বাড়াতেই হবে। জাতীয় আয়ের তুলনায় বাংলাদেশে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ, এটা একটা সমস্যা।

“টাকার অঙ্কে কিন্তু আমার বৈদেশিক ঋণ প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিরাশি থেকে একশ সতেরো হয়ে গেছে অর্থাৎ আমাকে রাজস্ব চল্লিশ শতাংশ বেশি কালেক্ট করতে হবে। এটা হিউজ সমস্যা। আমাকে ম্যাক্রো (সামস্টিক অর্থনীতি) স্ট্যাবিলিটি রাখতেই হবে। আমাকে রাজস্ব বাড়াতেই হবে। তা না হলে আমি ম্যাক্রো স্ট্যাবিলিটি রাখতে পারবো না। এবং আমার কাঠামোগত দুর্বলতা আছে যেসব সেক্টরে সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে করে বৈদেশিক মুদ্রা সেইভ করতে হবে।”

বোঝা জনগণের কাঁধে

এদিকে বিদেশি ঋণের সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়বে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে।

যেমন প্রত্যক্ষ কর হিসেবে আগামী অর্থবছরে আয়কর বাড়ানোর নানা চেষ্টা থাকবে বলে শোনা যাচ্ছে। আবার পরোক্ষ করের বেলায় যেমন মেট্রোরেলের টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তের কথা শোনা যাচ্ছে। এসব সিদ্ধান্ত বাজেটে পাশ হলে প্রত্যক্ষ কর হিসেবে জনগণকে বেশি টাকা আয়কর দিতে হবে। আর পরোক্ষ কর হিসেবে মেট্রেরেলে ভ্যাট কার্যকর হলে রেল যাত্রীরা এখন যে গন্তব্যে যেতে ১শ ভাড়া দেন সেখানে ১১৫ টাকা ভাড়া গুণতে হতে পারে।

বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকার মতো

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, শেষ পর্যন্ত দায় কিন্তু জনগণের কাঁধেই।

“বোঝা কিন্তু মানুষের ঘাড়েই। এই যে ঋণের বোঝাটা আমরা বলছি যে ঋণ কতো। অলরেডি বেড়েছে। এখন মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকার মতো। কিছুদিন আগে এটা এক লাখ টাকার মতো ছিল। আমরা প্রত্যকের মাথায় ঋণ নিয়ে ঘুরছি। সেটা যে আমাদেরকে দিতে হবে সেটা বলছি না কিন্তু এটাতো একটা বোঝা। এখন কোনো সময় সরকার হয়তো ভাবতে পারে যে আমি কর বাড়িয়ে দিলাম। মানুষের কাছ থেকে টাকা আহরণ করতে হবে। কিন্তু তখনই কর আহরণ করা যৌক্তিকতা থাকে যখন কি না অর্থনীতিতে সুযোগ সৃষ্টি সবার জন্য একই রকম হয়।”

সরকারের অবস্থান

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে সরকার সেটির আকার সব মিলিয়ে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রেকর্ড এক লক্ষ কোটি টাকার ওপরে অর্থায়নের পরিকল্পনা বৈদেশিক উৎস থেকে।

সরকার জোর দিয়ে একটি বিষয় বলে যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি।

বাংলাদেশের সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই ঋণ নিয়ে আসছে এবং যথাসময়ে পরিশোধ করছে।

কিন্তু ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করাটা সমস্যা কি না এ প্রশ্নে তিনি জোরালোভাবেই ঋণের পক্ষে অবস্থান নেন।

“কোনো সমস্যা না। সবাই এটা করে। ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণ নিতে হবে। আজকে যে আমি আগের ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন ঋণ নেব এই ঋণটা পরিশোধ করবো কবে আরো বিশ বছর পরে, চল্লিশ বছর পরে। এর মধ্যে কি আমাদের অর্থনীতি স্থবির দাঁড়ায় থাকবে। এটা হবে না। তাহলেতো আমাদের কমবেশি কাজ করে আমাদের অর্থনীতি স্ফীত হবে, আয় বাড়বে। আমরা যদি গত পঞ্চাশ বছর ঋণ করে বেঁচে থাকতে পারি তাহলে কি আগামী পঞ্চাশ বছর পারবো না।”

বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা যে সাবধান করছেন সেটিকে তিনি সাধুবাদ জানান। তবে অর্থনীতির বইয়ের সূত্র আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে পার্থক্য আছে সেটাও মনে করিয়ে দেন তিনি।

“ইকোনোমিস্টরা হিসাব-নিকাশ করে বলেন যে এরচেয়ে বেশি হওয়া উচিৎ না অভ্যন্তরীণ ঋণ, এগুলো গ্রামারের কথা। গ্রামার ভালো কিন্তু বাস্তব জগৎ ভিন্ন।”

ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে বলেই আশাবাদী এম এ মান্নান।

“জিডিপির আকার বাড়ছে না? বার্ষিক কালেকশন বাড়ছে না? আপনার আমার বিচারে, আশানুরূপ না হলেও বাড়ছেতো। রিজার্ভ কম হলেও আনুপাতিক হারেতো ভয়ঙ্কর নয়। রিজার্ভও কমবে, বাড়বে।

“আমার ধারণা সরকার প্রচুর সাবধানে আছে। এবং ইদানিংকালে এইসব কথাবার্তা বলে লাভ একটা হয়েছে যে সরকার আরো বেশি সাবধান হবে।” -বিবিসি

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: