সর্বশেষ আপডেট : ১০ ঘন্টা আগে
বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৩ খ্রীষ্টাব্দ | ২০ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

বীরকন্যা কাকন বিবির প্রয়ান

শেষ আক্ষেপ পূরণ হলো না বীরকন্যা, বীরপ্রতীক কাকন বিবির। গত বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত গেজেট না হওয়ায় শেষ আক্ষেপ পুরন হয়নি কাকনের। গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ১০ নম্বর কেবিনে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার শরীরিক অবস্থার অবনতি দেখে রাতেই চিকিৎসকেরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। গত বুধবার কাকন বিবির জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ড কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন তাকে রাজধানীর সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করার। কিন্তু তা করার আগেই ওই দিন তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯ টায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাকন বিবির মরদেহ তার মেয়ের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. একে মাহবুবুল হক হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া সিলেট জেলা প্রশাসন ও মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সকাল সাড়ে ৯টায় ওসমানী হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স কাকন বিবির মরদেহ নিয়ে দোয়ারাবাজারের পথে যাত্রা শুরু করেন তার স্বজনরা।

কাকন বিবির মেয়ে জামাই আব্দুল মতিন বলেন, ‘চার দিন আগে হঠাৎ করেই মা কাকন বিবির খুব জ্বর ওঠে। এরপর থেকে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। সোমবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তখনই ইউএনও কাকন বিবিকে দ্রুত ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসতে সবধরণের সহযোগিতা করেন। বুধবার রাতে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আব্দুল মতিন জানান, গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় কাকনের জানাজার নামাজ দোয়ারাবাজরে অনুষ্ঠিত হয়। ’

গত বছরের ২১ জুলাই ব্রেনস্টোক করেন কাকন বিবি। ওই সময় তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। বর্তমানে কাকন বিবির শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল করছে খুবই ধীরগতিতে।

কাকন বিবি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে কাকনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম পরিবর্তিত হয়। নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে। কাকন বিবি তিন দিনের কন্যাসন্তান সখিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান। তিনি এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবেই কাজ করেননি, করেছেন সম্মুখযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।

কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে কাকন বিবির মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়। পরবর্তীসময়ে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে কাকন বিবির বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করার পর তিনি আগের স্বামীর ঘর থেকে মেয়ে সখিনাকে নিয়ে আসেন। মেয়েকে নিয়ে এসে তিনি স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে মেয়েকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয় কাকনকে। এর পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখনই কাকন স্বামীকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। জুলাই মাসে তার সঙ্গে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড়ের। কাকন বিবি শুরু করেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সফল হন। গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফের ধরা পড়েন তিনি। এবার একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাকে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাকন বিবিকে পাকিস্তানি বাহিনী ফেলে রেখে যায়। তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তাকে প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখযুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। কাকন বিবি প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

জেলা বিএনপির শোক : সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক কাকন বিবির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিলেট জেলা বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার এক শোক বার্তায় সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম ও সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতীক কাকন বিবির অবদান জাতি সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। মরুহুমার বাংলাদেশের মহান মুক্তিযোদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। তার অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা খাকবে। যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করে ছিলেন তিনি। এই মহান যোদ্ধা ১৯৭১ সালে তিন দিন বয়সী মেয়ে সখিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান কাকন বিবি। সঙ্গে চালিয়ে যান গুপ্তচরের কাজ। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলার সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। টেংরাটিলা যুদ্ধের পর আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূরবীণটিলা, আধারটিলাসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন কাকন বিবি।
নেতৃবৃন্দ মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

এ বিভাগের অন্যান্য খবর

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি: মকিস মনসুর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম, নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ৯/আই, ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
ফোন: ০৮২১-৭২৬৫২৭, মোবাইল: ০১৭১৭৬৮১২১৪
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: